
প্রকাশিত: Wed, Jan 4, 2023 4:16 PM আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 12:19 PM
করোনার বিএফ-৭ ভ্যারিয়েন্ট, ঝুঁকি আছে কি বাংলাদেশের জন্য?
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম
ওমিক্রনের একটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে বিএফ-৭। বর্তমানে চীনে কোভিডের যে ঢেউটি চলছে, তার ৮০ শতাংশ সংক্রমণই হচ্ছে বিএফ-৭ ভ্যারিয়েন্টি দিয়ে। গত দু’বছর চীনে কোভিড মহামারী নিয়ন্ত্রণের ভেতরে থাকলেও ২০২২ সালের শেষে তা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা চারজন চীনা নাগরিকের একজনের শরীরে বিএফ-৭ উপধরনের সংক্রমণ ধরা পরেছে। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই চারজন আরোহীর সবারই প্রি-ফ্লাইট কোভিড টেস্ট নেগেটিভ ছিল। বিমানবন্দরে র্যাপিড এন্টিজেন টেস্টে তাদের একজনের কোভিড ধরা পরে এবং পরবর্তী সময়ে স্যাম্পল সিক্যুয়েন্সিং করে বিএফ-৭ উপধরন নিশ্চিত করা হয়। এই খবরে অনেকের মধ্যে কোভিড নিয়ে আবারও ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। ভ্রান্ত তথ্যও ছড়িয়ে পরছে চারদিকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে কি আবারও নতুন করে কোভিড মহামারী দেখা দিবে? বিএফ.৭ কি অতিসংক্রামক এবং পূর্বের ভ্যারিয়েন্টগুলো থেকেও মারাত্মক? বিএফ.৭ সংক্রমণে কি মারাত্মক কোভিড হতে পারে? ভ্যাকসিন নেয়ার পরও কি নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে উচ্চমাত্রায় সংক্রমণ বিদ্যমান সে সব দেশ থেকে নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর প্রবেশ বন্ধে কী পদ্ধতি নেওয়া দরকার? দেশে কি নতুন করে কোভিড রুল আরোপের প্রয়োজন আছে? প্রথমত ওমিক্রনের বিএফ.৭ উপধরনটি মূল ওমিক্রনের চেয়ে দুই-তিনগুন বেশি সংক্রামক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যারিয়েন্টটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। অর্থাৎ বিএফ.৭ সংক্রমণ গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দরকার হলে তা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে।
চীনে চলমান ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের জন্য কি এই বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টেই এককভাবে দায়ী? চীনে সনাক্তের আগেই বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশে আগস্ট মাসেই, তখন কিন্তু ওসব দেশে কোভিডের কোনো বড় ঢেউ ছিলো না। মহামারীর শুরু থেকেই চীনে জিরো-কোভিড পলিসি মেনে চলা হয়েছে, আর এ কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে দেশটিতে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে পারেনি। ফলে দেশটির বৃহৎ জনগোষ্ঠির মধ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ইমিউনিটি তৈরি হয়নি। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হলেও ওমিক্রন সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা খুব একটা কার্যকর নয়। ২০২২ সালে এসে চীনে যখন জিরো-কোভিড পলিসি শিথিল করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে ওমিক্রনের বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টটি দিয়ে।
বাংলাদেশেসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই ওমিক্রনের সংক্রমণ হয়েছে বিস্তৃত পর্যায়ে, যার ফলে জনসংখ্যার একটা বৃহৎ অংশে এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে ম্যাস ইমিউনিটি। এর ফলে বাংলাদেশে বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করলেও তাতে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিএফ.৭ ওমিক্রনের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি সংক্রামক তবে মারাত্মক না। বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি এবং সিভিয়ার কোভিড হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ বা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগ রয়েছে এবং যাদের বয়স ৬০ এর বেশি তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে।
যারা কোভিডের দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন বা পূর্বে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন তারাও বিএফ.৭ সহ করোনার যেকোনো ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হতে পারেন। বর্তমানের কোভিড ভ্যাকসিনগুলো তৈরি মূল উহান ভ্যারিয়েন্টকে টার্গেট করে। ওমিক্রনে মিউটেশন হয়েছে অনেক। এ কারণেই ভ্যাকসিন ইমিউনিটি ওমিক্রনের সংক্রমণ থেকে শতভাগ প্রতিরোধ করতে পারে না। তবে ভ্যাকসিন দেওয়াতে শরীরে যে অ্যাডাপটিভ ইমিউনিটি তৈরি হয় তা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে যেকোনো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সহায়তা করে। এর ফলেই ভ্যাকসিন দেওয়া শরীরে ভাইরাস সংক্রমণ হলেও তা হাল্কা সিম্পটম তৈরি করে ৫-৭ দিনের ভালো হয়ে যায়। এই কারণে সবাইকেই কোভিডের অন্তত দুটো ডোজ ভ্যাকসিন নিতে হবে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে দেশে বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ বন্ধ করা যায়? গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা পরিষ্কার যে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে কোভিডের ভ্যারিন্টেগুলোর বিস্তার বন্ধ করা অসম্ভব। তবে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগে এই বিস্তার কিছুটা ধীরগতি করা সম্ভব। কোভিডের প্রায় ৫০০টা ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত হয়েছে এবং ভাইরাসে মিউটেশন হচ্ছে ক্রমাগত। যেহেতু বিএফ.৭ তেমন কোন মারাত্মক ভ্যারিয়েন্ট না তাই এর প্রবেশ বন্ধে কঠোর কোন পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তবে যে সব দেশে বিএফ.৭ এর সংক্রমণ চলছে সে সব দেশ থেকে আগত সবার জন্য প্রি-ফ্লাইট কোভিড টেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফ্লাইটে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক এবং বিমান বন্দরে আগত করো কোভিডের সিম্পটম দেখা দিলে বাধ্যতামূলক অনসাইট র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করতে হবে। টেস্ট পজিটিভ হলে ৭ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন এবং স্যাম্পল সিক্যুয়েন্সিং করতে হবে ভ্যারিয়েন্ট নিশ্চিত করার জন্য। গণহারে অন-এরাইভাল কোভিড টেস্ট করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এ ধরনের পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি অনুসরণ করার পরিকল্পনা করছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দেশে কি এখনই আবার কোভিড রুল চালু করার দরকার আছে? এখনই দেশে কোভিড রুল চালু করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তবে নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে যে কেউ পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরিধান করতে পারে বা নিয়মিত হাত ধুতে পারে এতে সে যেকোনো ধরনের জীবানুর সংক্রমণ থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে। আমার মতে, এ মুহূর্তে হাসপাতালগুলোতে কোভিড রুল প্রয়োগ করা জরুরি। বিশেষ করে হাসপাতালে স্বাস্থসেবা প্রদানকারী সকলের জন্য মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে করে স্বাস্থকর্মীদের কাছ থেকে রোগীদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীগণ করোনা সংক্রমণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই স্ট্র্যাটেজি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে বুঝবেন যে আপনি কোভিডে আক্রান্ত? বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে সবচেয়ে কমোন লক্ষণগুলো হচ্ছে গলা ব্যাথা, সর্দি, হাঁচি সাথে সামান্য জ্বর, মাথাব্যাথা এবং পেটে সমস্যা থাকতে পারে। অর্থাৎ বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হলে তা অনেকটা সাধারণ ফ্লুর মতো মনে হতে পারে।
এমন হলে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা রাখুন। ৫ দিনের ভেতরে সিম্পটম না সেরে গেলে কোভিড টেস্ট করান। প্যারাসিটামল বা এন্টিহিস্টামিন ছাড়া কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। ওমিক্রনে হওয়া কোভিড কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই আপনা আপনি ভালো হয়ে যায় ৫-৭ দিনের ভেতরেই। তবে যাদের কোমর্বিডিটি রয়েছে বা যাদের বয়স ৬০ এর বেশি তাদের ক্ষেত্রে কোভিড হলে একজন চিকিৎকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, এতে করে কোভিডের জটিলতা এড়ানো সম্ভব। বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই এখনই। খুব সম্ভবত এই ভ্যারিয়েন্টি দেশে তেমন কোনো বড় মহামারী ঢেউ তৈরি করতে পারবে না।
লেখক: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
